কেন এবার হোয়াইট হাউসে এত খাতির পেলেন জেলেনস্কি

 

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি হোয়াইট হাউসে পৌঁছানোর পর তাঁকে এভাবেই উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি হোয়াইট হাউসে পৌঁছানোর পর তাঁকে এভাবেই উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পছবি: রয়টার্স     prothomalo news



ইউক্রেন যুদ্ধ অবসানের পথ নিয়ে আলোচনা করতে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ও ইউরোপীয় নেতাদের সঙ্গে গতকাল সোমবার হোয়াইট হাউসে বৈঠক করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।


 ‘প্রায় স্যুট’ পরে এদিন হোয়াইট হাউসে আসেন জেলেনস্কি।


ট্রাম্পকে খুশি করতেই কি নিজের স্বভাবের বিরুদ্ধে গিয়ে জেলেনস্কি এ পোশাক পরেছিলেন? গতকালের বৈঠক এটিসহ আরও কিছু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।


উষ্ণ পরিবেশ, কিন্তু অর্জন খুব সামান্যই




সাত ইউরোপীয় নেতা, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট, তাঁদের গাড়িবহর, ট্রাম্প প্রশাসনের কয়েক ডজন কর্মকর্তা এবং শতাধিক সাংবাদিক ওই বৈঠক সামনে রেখে গতকাল হোয়াইট হাউসে আসেন।


বৈঠক শুরুর আগে যে প্রশ্নগুলো সবচেয়ে জোরালো ছিল সেগুলোর অন্যতম ছিল—ট্রাম্প-জেলেনস্কি কি শান্তির পথে একমত হবেন?


 নাকি গত ফেব্রুয়ারিতে ওভাল অফিসে অনুষ্ঠিত বৈঠকের মতো এবারও বাগ্‌বিতণ্ডায় জড়াবেন?

গতকালের বৈঠকে এর কোনটিই ঘটেনি। ফেব্রুয়ারির বৈঠকে জেলেনস্কি তাঁর পোশাক ও আচরণের জন্য বড় তিরস্কারের মুখে পড়েছিলেন। এবার নিজের পোশাক ও আচরণ উভয়ই পরিবর্তন করেছেন তিনি।



জেলেনস্কিসহ হোয়াইট হাউসে যাওয়া ইউরোপীয় নেতারা সতর্কভাবে ট্রাম্পের সঙ্গে তাঁদের নীতিগত মতবিরোধ আড়াল করে রাখার চেষ্টা করেছেন। তাঁরা তাঁদের বক্তব্য অস্পষ্ট রেখেছেন এবং ট্রাম্পকে প্রশংসার বন্যায় ভাসিয়েছেন।



জেলেনস্কি এবার অনেকটা আনুষ্ঠানিক পোশাক পরে এসেছেন এবং ট্রাম্পের প্রতি বারবার ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেছেন। 

এর ফলাফলও পেয়েছেন। ফেব্রুয়ারির বৈঠকে ট্রাম্প তাঁর সঙ্গে যেটা করেছিলেন, এবার হোয়াইট হাউসে তার থেকে অনেক বেশি খাতির করেছেন।


বৈঠকে ট্রাম্প মস্কোর সঙ্গে কিয়েভের সম্ভাব্য শান্তি চুক্তির পর ইউক্রেনের নিরাপত্তায় সহায়তা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। 

এরপরও বলা যায়, ভূমি বিনিময়, নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বা নিষেধাজ্ঞা নিয়ে নিজেদের অবস্থানে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের তাৎক্ষণিক কোনো ইঙ্গিত কোনো পক্ষই দেখায়নি।


পরিবর্তে ট্রাম্প এ বৈঠক শেষ করেছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে পরবর্তী বৈঠক আয়োজনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে; যে বৈঠকে বাকি অনেক বিষয়ের সমাধান নিয়ে আলোচনা হবে।



ভলোদিমির জেলেনস্কি, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট

প্রশংসার ঝড়



‘আপনি কি একবারও “ধন্যবাদ” বলেছেন’—ফেব্রুয়ারির বৈঠকে আচমকা এ প্রশ্ন করে জেলেনস্কিকে তীব্র আক্রমণ করেছিলেন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভ্যান্স। 


ভ্যান্সের অভিযোগ ছিল, (রাশিয়ার বিরুদ্ধে) যুদ্ধে ইউক্রেনকে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনের জন্য জেলেনস্কি যথাযথ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেননি।


ধন্যবাদ দেওয়া বা কৃতজ্ঞতা প্রকাশের কমতি নিয়ে এবারের বৈঠকে যেন কোনো কথা না হয়, তা গতকাল নিশ্চিত করেছেন জেলেনস্কি। 


হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে নিজের উদ্বোধনী বক্তব্যে জেলেনস্কি আটবার ‘ধন্যবাদ’ বলেছেন, বেশির ভাগই ট্রাম্পকে উদ্দেশ্য করে। তা–ও আবার ১০ সেকেন্ডে চারবার ট্রাম্পকে ধন্যবাদ দিয়েছেন।


জেলেনস্কি বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট আপনাকে অনেক ধন্যবাদ...আপনার মনোযোগের জন্য ধন্যবাদ।

 এই হত্যাকাণ্ড থামাতে এবং এই যুদ্ধ শেষ করতে আপনার প্রচেষ্টা, ব্যক্তিগত প্রচেষ্টার জন্য অনেক ধন্যবাদ। ধন্যবাদ।’



জেলেনস্কি সোমবার যে পোশাক পরে হোয়াইট হাউসে উপস্থিত হন, সেটিকে এক ইউরোপীয় কূটনীতিক ‘প্রায় স্যুট’ বলে বর্ণনা করেন।


জেলেনস্কি তাঁর বক্তব্যে যুক্তরাষ্ট্রের ফার্স্ট লেডি মেলানিয়া ট্রাম্পকেও ধন্যবাদ দেন। 

এর আগে আলাস্কায় পুতিনের সঙ্গে ট্রাম্পের বৈঠকে মেলানিয়া ইউক্রেনে অপহৃত শিশুদের বিষয়ে রুশ প্রেসিডেন্টকে একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন।

মার্কিন প্রেসিডেন্টকে উদ্দেশ করে জেলেনস্কি বলেন, ‘এ সুযোগ (ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকের) ব্যবহার করে আপনার স্ত্রীকেও আমি ধন্যবাদ জানাচ্ছি।’


বিবিসির খবরে বলা হয়, জেলেনস্কি এদিন ট্রাম্পের হাতে তাঁর স্ত্রী ওলেনা জেলেনস্কার লেখা একটি চিঠি তুলে দিয়ে বলেন, ‘এটা আপনার জন্য নয়, আপনার স্ত্রীর জন্য।’



সোমবারের বৈঠকে এমন খোশমেজাজে দেখা গেছে জেলেনস্কি ও ট্রাম্পকে
সোমবারের বৈঠকে এমন খোশমেজাজে দেখা গেছে জেলেনস্কি ও ট্রাম্পকে
ছবি: এএফপি    prothomalo news



জেলেনস্কি তাঁর বক্তব্যে ইউরোপীয় নেতাদেরও ধন্যবাদ দেন। তিনি বলেন, ‘এ শান্তি প্রচেষ্টাকে সমর্থন করার জন্য আমাদের সব অংশীদারকে ধন্যবাদ। আমাদের বৈঠকের পর,

 আমরা আমাদের চারপাশের যে নেতাদের পেতে চলেছি—যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি…ইউক্রেনের চারপাশে থাকা সব অংশীদার, যারা আমাদের সমর্থন করছে, তাদের সবাইকে ধন্যবাদ।’

নিজের বক্তব্যের শেষে ট্রাম্পকে উদ্দেশ করে জেলেনস্কি আবারও বলেন, ‘আপনার আমন্ত্রণের জন্য অনেক ধন্যবাদ।’

ফেব্রুয়ারির বৈঠকে ভ্যান্স সরব ভূমিকায় থাকলেও গতকাল তাঁকে বেশির ভাগ সময় চুপচাপ বসে থাকতে দেখা গেছে।




সামরিক আদলে আনুষ্ঠানিক পোশাক



গতকালের বৈঠকের মতো গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক আর হতে পারে না। কিন্তু এদিন ওয়াশিংটন ডিসিতে কূটনীতিকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কৌতূহল যে বিষয় নিয়ে ছিল,

 তা হলো ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট কি স্যুট পরবেন?

এর উত্তর: অনেকটা তেমনই।


জেলেনস্কি গতকাল যে পোশাক পরে হোয়াইট হাউসে উপস্থিত হন, সেটিকে এক ইউরোপীয় কূটনীতিক ‘প্রায় স্যুট’ বলে বর্ণনা করেছেন। 


তিনি কালো রঙের জ্যাকেট বা ব্লেজারের মতো যে পোশাক পরে এসেছিলেন, সেটিতে কলার ও বুকপকেট ছিল। তবে টাই পরেননি। 


জেলেনস্কির পোশাকে যেমন ছিল সামরিক আভাস, তেমন ছিল অফিস বা সভাকক্ষের আনুষ্ঠানিকতার ছোঁয়া।



ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকের সময় পরিধেয় পোশাকের সূক্ষ্ম বিষয়গুলোও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ফেব্রুয়ারির বৈঠকে জেলেনস্কি হোয়াইট হাউসে স্যুট পরে না আসায় ট্রাম্প অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন।


তবে এবার পোশাকের জন্য প্রশংসিত হয়েছেন জেলেনস্কি।


যখন ওভাল অফিসে একজন সাংবাদিক জেলেনস্কিকে লক্ষ্য করে ‘দারুণ দেখাচ্ছে’ বলে প্রশংসা করেন, তখন ট্রাম্প তাঁর সঙ্গে একমত পোষণ করে বলে ওঠেন, ‘আমিও একই কথা বলেছি।’





যুদ্ধবিরতি নিয়ে বিভক্তি



জেলেনস্কিসহ হোয়াইট হাউসে যাওয়া ইউরোপীয় নেতারা সতর্কভাবে ট্রাম্পের সঙ্গে তাঁদের নীতিগত মতবিরোধ আড়াল করে রাখার চেষ্টা করেছেন। 


তাঁরা তাঁদের বক্তব্য অস্পষ্ট রেখেছেন এবং ট্রাম্পকে প্রশংসার বন্যায় ভাসিয়েছেন। তবে একটি দ্বিমতের বিষয় স্পষ্টভাবে সামনে এসেছে।



কাদের সেনা মোতায়েন হবে



রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যে একটি দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি নিশ্চিত করতে যুক্তরাষ্ট্র কী কী সহায়তা দেবে, সেটি এ বৈঠক ঘিরে বড় ধরনের রহস্যের জন্ম দিয়েছিল।


বৈঠকে ট্রাম্প রাশিয়ার কাছ থেকে ইউক্রেনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সেখানে মার্কিন সেনা ‘মোতায়েনের’ কোনো প্রস্তাব দেননি।


 এ থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে কোথাও সামরিকভাবে জড়াতে বা পারমাণবিক শক্তিধর কোনো দেশের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে লিপ্ত হতে অনিচ্ছুক।


পরিবর্তে, ট্রাম্প ইউক্রেনে অস্ত্র বিক্রি করার প্রস্তাব দিয়েছেন এবং প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, মার্কিনরা ইউক্রেনে ব্যবসা করবে। 


ইউক্রেনীয়রা ট্রাম্পের এ প্রতিশ্রুতিকে তাঁদের নিরাপত্তা নিশ্চয়তার তুলনায় অনেক কম বলে মনে করছেন। তবে ইউরোপীয় দেশগুলো নিজস্ব বাহিনীর মাধ্যমে ইউক্রেনে শান্তিরক্ষা মিশন পাঠানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে।



জার্মানির চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মের্ৎস উপস্থিত নেতা ও সাংবাদিকদের লক্ষ্য করে বলেছেন, তিনি দেখতে চান পুতিন একটি যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়েছেন।


ট্রাম্প বলেছেন, তিনি পুতিনকে ফোন করবেন এবং ইউক্রেনের সঙ্গে একটি ত্রিপক্ষীয় বৈঠক আয়োজন করবেন। সময় ও স্থান পরে নির্ধারণ করা হবে।



ট্রাম্প দীর্ঘদিন ধরে ইউক্রেনে একটি যুদ্ধবিরতির জন্য চাপ দিয়ে আসছিলেন। কিন্তু গত শুক্রবার আলাস্কায় পুতিনের সঙ্গে বৈঠকের পর তিনি তা থেকে প্রায় সরে যান। 


তিনি সরাসরি শান্তিচুক্তির দিকে অগ্রসর হওয়ার কথা বলেন। এটি ইউক্রেনের জন্য একটি কূটনৈতিক পরাজয় হিসেবে দেখা হচ্ছে।


মের্ৎস বলেন, ‘সত্যি বলতে, আমরা সবাই চাই যুদ্ধবিরতি দেখতে। একটি যুদ্ধবিরতি ছাড়া পরবর্তী বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছে—আমি এমনটা কল্পনাও করতে পারছি না। তাই আসুন, এটা নিয়ে কাজ করি।’


ট্রাম্প পাল্টা যুক্তি দেখিয়ে বলেন, শুরুতে একটি যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছানো ছাড়াই তিনি অনেক সংঘাতের সমাধানে পৌঁছেছেন।


এরপর কী



ট্রাম্প বলেছেন, তিনি পুতিনকে ফোন এবং ইউক্রেনের সঙ্গে একটি ত্রিপক্ষীয় বৈঠক আয়োজন করবেন, সময় ও স্থান পরে নির্ধারণ করা হবে।


ব্যক্তিগতভাবে কিছু সংশয় থাকলেও হোয়াইট হাউসে জড়ো হওয়া নেতারা মনে করেন, এটাই পরবর্তী যৌক্তিক পদক্ষেপ।


তবে ট্রাম্প ও তাঁর মিত্ররা যেভাবে বলছেন, সামনে অগ্রসর হওয়ার পথ তার চেয়ে অনেক জটিল।





প্রথম আলোর খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন





0 Comments

Post a Comment

Post a Comment (0)

Previous Post Next Post