ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির সাম্প্রতিক অনুপস্থিতি নিয়ে দেশটির জনগণের মধ্যে সৃষ্ট উদ্বেগ, নানা প্রশ্ন ও এর জবাব খোঁজার চেষ্টা করছেন ফারনাজ ফসিহি। এ বিষয়ে তাঁর লেখা এই প্রতিবেদন গতকাল প্রকাশ করেছে প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমস। ফারনাজ দ্য টাইমসের জাতিসংঘ ব্যুরো চিফ। ইরান ইস্যুতেও তিনি লেখালেখি করেন। এ ছাড়া ১৫ বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে লিখছেন তিনি। ভাষান্তর করেছেন মো. আবু হুরাইরাহ্
দেশজুড়ে মানুষ যখন উৎকণ্ঠায়, তখন ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের একজন উপস্থাপক সরাসরি প্রশ্ন তুলে দিলেন।
এ প্রশ্নই এখন ঘুরপাক খাচ্ছে দেশটির রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে শুরু করে মাঠে-ময়দানে অনেকের মধ্যে।
‘মানুষ সর্বোচ্চ নেতাকে নিয়ে খুব চিন্তিত’, গত মঙ্গলবার উপস্থাপক আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির দপ্তরের এক কর্মকর্তাকে এ কথা বলেন। তিনি জানতে চান, ‘তাঁর কী অবস্থা, বলতে পারেন?’
উপস্থাপক ওই কর্মকর্তাকে জানান, দর্শকদের কাছ থেকে এই একই প্রশ্নে ভরে গেছে বার্তাকক্ষ। তবে খামেনির আর্কাইভ দপ্তরের কর্মকর্তা মেহদি ফাজায়েলি সরাসরি কোনো উত্তর দেননি।
উল্টো ফাজায়েলি বলেন, ‘আমরাও অনেক জায়গা থেকে এমন উদ্বেগের খবর পাচ্ছি। ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের ভয়াবহ বোমা হামলার পর আয়াতুল্লাহর নিরাপত্তা নিয়ে বহুজন উদ্বিগ্ন।’
‘আমাদের সবাইকে তাঁর জন্য দোয়া করতে হবে,’ বলেন ফাজায়েলি।
এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘সর্বোচ্চ নেতাকে রক্ষা করা যাঁদের দায়িত্ব, তাঁরা তাঁদের কাজ ভালোভাবেই করছেন।
আল্লাহ চাইলে, আমাদের জনগণ তাঁদের নেতাকে সঙ্গে নিয়েই বিজয় উদ্যাপন করতে পারবেন।’
প্রায় এক সপ্তাহ ধরেই জনসমক্ষে অনুপস্থিত খামেনি। কোনো ভাষণ বা বার্তাও দেননি। অথচ দেশ তখন গভীর সংকটে।
খামেনির এই নীরবতা জন্ম দিচ্ছে নানা প্রশ্ন ও জল্পনার—সাম্প্রতিক বড় সিদ্ধান্তগুলোতে তাঁর ভূমিকা কতটুকু? তাঁর কাছে পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়েছে কি?
তিনি এখনো দেশ পরিচালনায় সক্রিয়? তিনি অসুস্থ, আহত কিংবা আদৌ বেঁচে আছেন কি?
এ সময়ের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালায়, জবাবে (সোমবার) ইরান কাতারে অবস্থিত মার্কিন ঘাঁটিতে (মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় ঘাঁটি) ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে।
এরপরই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় ইরান ও ইসরায়েল এক যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছায়, যা কার্যকর হয় মঙ্গলবার সকাল থেকে।
এই পুরো সময়ে খামেনি ছিলেন অনুপস্থিত। সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, তিনি এক সুরক্ষিত বাংকারে আছেন এবং হত্যাচেষ্টার আশঙ্কায় সব ধরনের ইলেকট্রনিক যোগাযোগ এড়িয়ে চলছেন।
সর্বোচ্চ নেতার এমন অনুপস্থিতি শুধু জনসাধারণ নয়, রাজনৈতিক মহলেও ব্যাপক উদ্বেগ তৈরি করেছে।
‘খানমান’ নামের একটি দৈনিক পত্রিকার প্রধান সম্পাদক মোহসেন খালিফেহ বলেন, ‘খামেনির কয়েক দিনের এ অনুপস্থিতি আমাদের, যাঁরা তাঁকে ভালোবাসি, গভীর উদ্বেগে ফেলেছে।’
দুই সপ্তাহ আগেও যে আশঙ্কা অকল্পনীয় ছিল, তা এখন স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘যদি তিনি (খামেনি) মারা যান, তাঁর জানাজার মিছিল হবে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ও গৌরবময়।’
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে প্রতিটি বড় সিদ্ধান্তের চূড়ান্ত অনুমোদন দেন খামেনি।
সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ সামরিক পদক্ষেপ, যেমন যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটিতে হামলা বা ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধবিরতির মতো সিদ্ধান্তে তাঁর অনুমোদন অত্যাবশ্যক।
যাহোক, ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আহ্বানে এবং কাতারের আমিরের মধ্যস্থতায় দ্রুত সম্পাদিত হয়।
তবে ইরানের ঊর্ধ্বতন সামরিক ও সরকারি কর্মকর্তারা গত কয়েক দিনে তাঁরা খামেনির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন কি না বা কোনোভাবে যোগাযোগ হয়েছে কি না, সে বিষয়ে খোলাখুলি কিছু বলেননি।
এ নীরবতা জন্ম দিচ্ছে নানা প্রশ্ন ও জল্পনার—সাম্প্রতিক বড় সিদ্ধান্তগুলোতে খামেনির ভূমিকা কতটুকু? তাঁর কাছে পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়েছে কি? তিনি এখনো দেশ পরিচালনায় সক্রিয়? তিনি অসুস্থ, আহত কিংবা আদৌ বেঁচে আছেন কি?
রাজনৈতিক বিশ্লেষক হামজা সাফাভি আয়াতুল্লাহ খামেনির শীর্ষ সামরিক উপদেষ্টা ও রেভল্যুশনারি গার্ডস কোরের জেনারেল ইয়াহিয়া সাফাভির ছেলে।
হামজা জানান, ইরানের নিরাপত্তা বাহিনী বিশ্বাস করে, যুদ্ধবিরতির মধ্যেও ইসরায়েল খামেনিকে হত্যাচেষ্টা চালাতে পারে।
তাই তাঁর নিরাপত্তায় কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে, বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ প্রায় বন্ধ রয়েছে।
চ্যাথাম হাউসের মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকাবিষয়ক পরিচালক সানাম ভাকিল বলেন, খামেনির অনুপস্থিতি উল্লেখযোগ্য একটি ঘটনা এবং এটি এই ইঙ্গিত দেয়, ইরানি নেতৃত্ব এখন অতিমাত্রায় সতর্ক ও নিরাপত্তাকেন্দ্রিক ভাবনায় চলছে।
আশুরার আগে যদি খামেনিকে দেখা না যায়, তাহলে তা হবে খারাপ সংকেত। তাঁকে অবশ্যই জনসমক্ষে আসতে হবে।
সাফাভি বলেন, ‘দেশকে এ সংকট থেকে উত্তরণে এখন বাস্তবমুখী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানের মতো নেতাদের ক্ষমতা বাড়ানো হচ্ছে।’
তবে সাফাভির ধারণা, খামেনি এখনো কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত দূর থেকে অনুমোদন দিচ্ছেন।
তবু খামেনির অনেক সমর্থক এখনো সামাজিকমাধ্যমে বলছেন, তাঁরা সর্বোচ্চ নেতাকে না দেখা বা তাঁর কথা না শোনা পর্যন্ত ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বিজয়ের আনন্দ অনুভব করতে পারছেন না।
খামেনির অনুপস্থিতিতে সক্রিয় নানা পক্ষ
সরকারের নীতিনির্ধারণে যুক্ত চারজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, খামেনির অনুপস্থিতিতে রাজনীতিক ও সামরিক নেতারা নতুন নতুন জোট গঠন করছেন এবং ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব নিয়ে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছেন।
কেউ কেউ তেহরানের পারমাণবিক কর্মসূচি, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের মধ্যস্থতা কিংবা ইসরায়েলের ব্যাপারে অবস্থান নিয়ে ভিন্নমত পোষণ করছেন।
এ মুহূর্তে দৃশ্যত যে গোষ্ঠী অপেক্ষাকৃত প্রভাবশালী, তারা সংযম ও কূটনৈতিক পথ গ্রহণের পক্ষে। এ গোষ্ঠীর নেতৃত্বে রয়েছেন প্রেসিডেন্ট পেজেশকিয়ান।
তিনি এমনকি যুক্তরাষ্ট্র ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালানোর পরও আলোচনায় ফেরার ইঙ্গিত দিয়েছেন।
তাঁর মিত্রদের মধ্যে আছেন আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির ঘনিষ্ঠজন ও বিচার বিভাগের প্রধান গোলাম হোসেইন মোহসেনি-এজেই ও সশস্ত্র বাহিনীর নতুন প্রধান মেজর জেনারেল আবদুর রহিম মুসাভি।
গতকাল বুধবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রেসিডেন্ট পেজেশকিয়ান বলেন, ‘এই যুদ্ধ এবং জনগণের ঐক্য আমাদের শাসনব্যবস্থা ও সরকারের আচরণে নতুন চিন্তার সুযোগ এনে দিয়েছে।
এটা পরিবর্তনের এক সোনালি সুযোগ।’
ইরানকে আরও সমৃদ্ধ ও সামাজিকভাবে উদার করা এবং পশ্চিমাদের সঙ্গে আরও বেশি যোগাযোগ স্থাপন করে চলার প্রতিশ্রুতি দিয়ে গত বছর ক্ষমতায় আসেন পেজেশকিয়ান।
সরকার এখন জাতীয়তাবাদী আবেগ কাজে লাগাতে চাইছে। এটি জন্ম নিয়েছে ইসরায়েলের ভয়াবহ হামলার পর।
ইরানি কর্মকর্তারা বলছেন, হামলায় ছয় শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছেন। ওই আবেগ কাজে লাগানোর অংশ হিসেবে মঙ্গলবার রাজধানী তেহরানের আজাদি স্কয়ারে (স্বাধীনতার প্রতীকী স্থাপনা) এক উন্মুক্ত কনসার্ট আয়োজন করা হয়।
এরপর আলোক প্রদর্শনীতে জরুরি সেবা বিভাগের কর্মীদের ছবি তুলে ধরা হয় স্কয়ারের স্মৃতিসৌধে।
ইরানের নিরাপত্তা বাহিনী বিশ্বাস করে, যুদ্ধবিরতির মধ্যেও ইসরায়েল খামেনিকে হত্যাচেষ্টা চালাতে পারে। তাই তাঁর নিরাপত্তায় কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে, বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ প্রায় বন্ধ রয়েছে।
হামজা সাফাভি, রাজনৈতিক বিশ্লেষক
তবে ভিন্নমতাবলম্বী গোষ্ঠীগুলোর তৎপরতাও চলছে বলে জানান কর্মকর্তারা। কট্টরপন্থী রাজনীতিক সাঈদ জলিলির নেতৃত্বে থাকা একটি রক্ষণশীল গোষ্ঠী প্রকাশ্যে প্রেসিডেন্ট ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সমালোচনা করেছে।
‘বিস্ময়কর’ যুদ্ধবিরতি ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আবারও পারমাণবিক আলোচনা শুরুর ইঙ্গিতে নিন্দা জানিয়েছে তারা।
এই গোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছেন পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠ রক্ষণশীল এমপিরা ও রেভল্যুশনারি গার্ডের কিছু জ্যেষ্ঠ কমান্ডার।
সাঈদ জলিলি ও রেভল্যুশনারি গার্ডসের ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক বিশ্লেষক ফুয়াদ ইজাদি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক পোস্টে বলেন,
পেজেশকিয়ানের আলোচনার বার্তা এখন মনে করিয়ে দিচ্ছে, ‘ইরানের প্রেসিডেন্টের দেশ পরিচালনার প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক দক্ষতা নেই।’
এতে পাল্টা জবাব দেন প্রেসিডেন্টের প্রধান যোগাযোগ কর্মকর্তা আলী আহমাদনিয়া। তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লেখেন, ‘আমরা ১২ দিন ধরে দিনরাত ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধ করছি।
এখন কি তোমাদের সঙ্গেও লড়তে হবে, তোমরা যারা কলম দিয়ে শত্রুর খেলায় ঘুঁটি সাজাচ্ছ।’
পারমাণবিক কর্মসূচির ভবিষ্যৎ নিয়েও প্রশ্ন
ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির ভবিষ্যৎ নিয়েও প্রশ্ন রয়ে গেছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি ও পারমাণবিক শক্তি সংস্থার প্রধান মোহাম্মদ এসলামি স্থানীয়
সংবাদমাধ্যমকে জানান, ইরান পারমাণবিক স্থাপনা পুনর্গঠন ও ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কার্যক্রম চালিয়ে যাবে।
যুক্তরাজ্যের নীতি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান চ্যাথাম হাউসের মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকাবিষয়ক পরিচালক সানাম ভাকিল বলেন,
‘খামেনির অনুপস্থিতি উল্লেখযোগ্য এক ঘটনা এবং এটি এই ইঙ্গিত দেয়, ইরানি নেতৃত্ব এখন অতিমাত্রায় সতর্ক ও নিরাপত্তাকেন্দ্রিক ভাবনায় চলছে।’
‘আসছে আশুরার (১০ মহররম) আগে যদি খামেনিকে দেখা না যায়, তাহলে তা হবে খারাপ সংকেত। তাঁকে অবশ্যই জনসমক্ষে আসতে হবে,’ বলেন ভাকিল।
প্রথম আলোর খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
Post a Comment