কুর্দি কমান্ডারের হুঁশিয়ারি সিরিয়ায় আইএসের ফেরার ঝুঁকি দ্বিগুণ বেড়েছে

 

ইসলামিক স্টেটের (আইএস) বিরুদ্ধে অভিযানে সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সেসের (এসডিএফ) সদস্যরা। সিরিয়ার উত্তর দিকের রাক্কা প্রদেশে, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ফাইল ছবি : রয়টার্স



সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের পতনের পর দেশটিতে বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে। বিশৃঙ্খলার সুযোগে ইসলামিক স্টেটের (আইএস) ফিরে আসার পথ প্রশস্ত হয়েছে বলে মনে করেন এক কুর্দি কমান্ডার, যিনি ২০১৯ সালে সিরিয়ায় এ জঙ্গি গোষ্ঠীটিকে পরাজিত করতে ভূমিকা রেখেছিলেন। তিনি বলেন, আইএসের ফেরা এরই মধ্যে শুরু হয়েছে।



সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সেসের (এসডিএফ) জেনারেল মাজলুম আবদির মতে, ‘দায়েশের (আইএস) কার্যক্রম উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। এ জঙ্গি গোষ্ঠীর পুনরুত্থানের ঝুঁকি দ্বিগুণ হয়েছে। বর্তমানে তাঁরা আগের চেয়ে বেশি সক্ষম আর তাঁদের সুযোগ-সুবিধাও বেড়েছে।’

এসডিএফের প্রধানত কুর্দি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর একটি জোট। যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন পেয়ে আসছে এ জোট।

গোয়েন্দা প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে মাজলুম বলেন, সিরিয়ার সরকারি বাহিনীর ফেলে যাওয়া কিছু অস্ত্র ও গোলাবারুদ আইএস সদস্যদের হাতে চলে গেছে।



উদ্বেগ প্রকাশ করে মাজলুম বলেছেন, সিরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে এসডিএফ পরিচালিত কারাগারগুলো আইএস যোদ্ধারা ভাঙার চেষ্টা করবেন। এ ধরনের ‘হুমকি’ রয়েছে। এসব কারাগারে আইএসের প্রায় ১০ হাজার সদস্য বন্দী রয়েছেন। তা ছাড়া এসডিএফ নিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন শিবিরে তাঁদের পরিবারের প্রায় ৫০ হাজার সদস্য রয়েছেন।



এসডিএফের জেনারেল মাজলুম আবদি বিবিসিকে গভীর রাতে এ সাক্ষাৎকার দেন। নিরাপত্তার কারণে তিনি যে স্থানে এই সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, তার নাম প্রকাশ করা হয়নি।



বাশার সরকারের হাতে চারবার আটক হওয়া এ জেনারেল অবশ্য তাঁর পতনকে স্বাগত জানিয়েছেন। কিন্তু তাঁকে ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। পুরোনো লড়াই আবার নতুন করে তাঁকে শুরু করতে হবে, এই ঝুঁকি দেখে তিনি হতাশা প্রকাশ করেন।



মাজলুম বলেছেন, ‘আমরা আইএসের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি। এতে আমাদের ১২ হাজার সদস্যের প্রাণ গেছে। আমার মনে হয়, কিছু কিছু স্তরে আগে আমরা আগে যেখানে ছিলাম, আমাদের আবার সেখানে ফিরতে হবে।’



কুর্দি এ জেনারেল বলেন, ‘আইএসের পুনরুত্থানের ঝুঁকি বেড়েছে। কারণ, এসডিএফের ওপর প্রতিবেশী তুরস্ক এবং তাদের সহায়তাপুষ্ট বিদ্রোহী গোষ্ঠীর হামলা বেড়েছে। এতে করে আমাদের অন্য জায়গা থেকে সেখানে কিছু সেনা পাঠাতে হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে এসডিএফকে আইএসের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান বন্ধ করতে হচ্ছে। আমাদের কারাগার পাহারায় থাকা কয়েক হাজার সদস্যের একটি বাহিনীর কয়েক শ সদস্য নিজেদের গ্রাম রক্ষার জন্য বাড়িতে ফিরে গেছেন।’



আঙ্কারার চোখে অবশ্য এসডিএফ মূলত পিকেকের বর্ধিত সংস্করণ। এ গোষ্ঠী তুরস্কের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন বিদ্রোহ করে আসছে। তুরস্কের সরকারের বিরুদ্ধে কয়েক দশক ধরে বিদ্রোহ চালিয়ে আসা কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের এই সংগঠনকে তাই নিষিদ্ধ করেছে আঙ্কারা। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পক্ষ থেকে পিকেকে সন্ত্রাসীর তকমা পেয়েছে।



সিরিয়ার উত্তর-পূর্ব দিকের কুর্দিদের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে ৩০ কিলোমিটারের একটি ‘বাফার জোন’ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে আসছে তুরস্ক। বাশারের পতনের পর থেকে এই অঞ্চল প্রতিষ্ঠার জন্য তারা উঠেপড়ে লেগেছে।



জেনারেল মাজলুম বলেছেন, ‘এখন তুরস্কই এক নম্বর হুমকি। কারণ, তাদের বিমান হামলায় আমাদের সেনারা নিহত হচ্ছেন। এসব হামলা অবশ্য বন্ধ করতে হবে। কারণ, তাদের হামলার কারণে বন্দীশালার নিরাপত্তা থেকে আমাদের মনোযোগ অন্য দিকে চলে যাচ্ছে। তবে এসব সত্ত্বেও আমরা আমাদের সর্বোচ্চ করার চেষ্টা করছি।’

যেসব কারাগারে আইএস যোদ্ধা বা সমর্থকদের আটক রাখা হয়েছে সেগুলোর মধ্যে আল-সিনা সবচেয়ে বড়। এ কারাগারের ভেতরে কয়েক স্তরের নিরাপত্তা রয়েছে। কারাগারটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দেখে চিন্তিত বলে মনে হয়েছে।



আল-হাসাকাহ শহরের সাবেক শিক্ষা ইনস্টিটিউটে প্রায় পাঁচ হাজার ব্যক্তিকে আটক রাখা হয়েছে। তাঁরা সন্দেহভাজন আইএস যোদ্ধা বা সমর্থক।

প্রতিটি সেলই তালাবদ্ধ এবং তিনটি বোল্ট দিয়ে সুরক্ষিত। ভারী লোহার গেট দিয়ে বারান্দাগুলো কয়েকটি ভাগে ভাগ করা। মাস্ক পরা প্রহরীদের হাতে রয়েছে লাঠি। এখানে প্রবেশ করতে পারাটা দুর্লভ।



বিবিসির পক্ষ থেকে দুটি কক্ষের ভেতরে একঝলক দেখার অনুমতি মিলেছিল। কিন্তু ভেতরে থাকা ব্যক্তিদের সঙ্গে তারা কথা বলতে পারেনি। সেখানকার বন্দীদের কাছে সাংবাদিক যাওয়ার কথা জানানো হয়েছিল এবং ইচ্ছা করলে তাঁদের মুখ ঢেকে রাখার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। কিছু ব্যক্তি মুখ ঢেকে রেখেছিলেন। বেশির ভাগ নীরবে বসে ছিলেন। দুই ব্যক্তি মেঝেতে ইতস্তত হাঁটছিলেন।



কুর্দি নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা বলেন, আল-সিনার অধিকাংশ কয়েদি আইএসের পতনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তাঁদের সঙ্গে ছিলেন। তাঁরা গোষ্ঠীটির আদর্শের প্রতি গভীরভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন।


বিবিসির পক্ষ থেকে ২৮ বছর বয়সী এক বন্দীর সঙ্গে দেখা করার ও কথা বলার সুযোগ মেলে। পাতলা গড়নের মৃদুভাষী এ ব্যক্তি নিজের নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি। তিনি যদিও দাবি করেন, তিনি নির্দ্বিধায় বিবিসিকে সব কথা বলছেন, তার পরও তিনি মূল বিষয়ে তেমন কিছু বলেননি।



ওই বন্দী বিবিসিকে বলেন, সাইপ্রাসে নিজের দাদিকে দেখার জন্য ১৯ বছর বয়সে তিনি তাঁর নিজের দেশ অস্ট্রেলিয়া ছেড়েছিলেন। এরপর সেখান থেকে একটি বিষয় অন্য বিষয়ে গড়ায়। তিনি শেষ পর্যন্ত আলেপ্পো এসে পৌঁছান।



এই যুবক বলেন, ‘সেখান থেকে একটি বিষয় আমাকে অন্য দিকে নিয়ে যায়। আমি আলেপ্পোতে এসে পৌঁছাই।’ তিনি দাবি করেন, আইএস যখন সিরিয়ার রাক্কা শহর দখলে নেয়, তখন তিনি সেখানে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান (এনজিওতে) কাজ করছিলেন।



বিবিসির পক্ষ থেকে তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়, আপনার হাতে কি রক্ত আছে, আপনি কি কোনো মানুষ হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিলেন? খুব নিচু স্বরে তিনি জবাব দেন, ‘না, আমি জড়িত ছিলাম না।’



আইএসের কর্মকাণ্ড তিনি সমর্থন করেন কি না এমন প্রশ্নের উত্তর দেননি ওই যুবক। বলেন, এতে তাঁর মামলার ওপর প্রভাব পড়তে পারে।

ওই বন্দী ব্যক্তি আশা করেন, এক দিন তিনি আবার অস্ট্রেলিয়ায় ফিরে যাতে পারবেন। তবে নিজ দেশে তাঁকে স্বাগত জানানো হবে কি না, এ বিষয়ে তিনি নিশ্চিত নন।

(ওরলা গুয়েরিন, বিবিসির জ্যেষ্ঠ আন্তর্জাতিক সংবাদদাতা। তিনি বর্তমানে উত্তর-পূর্ব সিরিয়া থেকে প্রতিবেদন লিখছেন।)




0 Comments

Post a Comment

Post a Comment (0)

Previous Post Next Post